সীমা দাস সীমু || Tuesday 27 October 2009
‘কি মহিমা করলেন গো সাঁই, বোঝা গেল না !’
ফকির লালন শাহ: প্রাণের সুরক্ষা ও পরমার্থ প্রতিষ্ঠার লড়াই
ছেঁউড়িয়া সাঁইজীর ধাম – এখানে ফকির লালন শাহের সমাধিক্ষেত্র। তিনি চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন, তাঁর সমাধির পাশেই তাঁকে লালন পালন করেছেন যে মা সেই ফকির মতিজানের কবর। তাঁর ইচ্ছানুসারেই দুই জনে পাশাপাশি শুয়ে আছেন। বাংলা ১২৯৭ পয়লা কার্তিক (ইংরেজী ১৭ অক্টোবর, ১৮৯০ সাল) গান গাইতেই তিনি ভোর পাঁচটায় তাঁর ভক্তদের বললেন, আমি চললাম। এটাই ছিল তাঁর তিরোধান। এখন এই ‘তিরোধান’ -কেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী ‘মৃত্যুদিবস’ হিসেবে পালন করছে। ‘তিরোধান’ কথাটি যে ভাবগত তাৎপর্য সেটা হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। লালন হয়ে গিয়েছেন নিছকই একজন ‘ব্যক্তি’। যে ভাব রক্তমাংসের পাত্র হয়ে বিশেষ সময়ে ও বিশেষ কালে নিজেকে ব্যক্ত করেছে, সেই ভাব তো আর হারিয়ে যায় নি, অন্য কোন শরীরে, অন্য কোন জীবিত মানুষ, নতুন গুরুর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এই ভাবের বিকাশ ঘটবার সম্ভাবনা সবসময় থেকেই যায়। যে ইঙ্গিত তিরোধান ও আবির্ভাবের ধারণার মধ্যে নিহিত রয়েছে তার তাৎপর্য হারিয়ে গিয়েছে। এখন প্রায় নিয়মিতভাবেই প্রতিবছর তিনদিন অর্থাৎ ১৬ থেকে ১৮ অক্টোবর সাঁইজীর তিরোধান দিবস পালন করান হয়।
বাংলা ১৪১৬ সাল অনুযায়ী কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন সাঁইয়ের ১১৯তম তিরোধান দিবস ছিল পহেলা কার্তিক। কুষ্টিয়া একসময় ছিল বৃহত্তর নদিয়া জেলার অংশ। নদিয়ায় যে ভাবের তুফান তুলছিলেন ‘তিন পাগল’ কুষ্টিয়া সেই নদিয়ারই প্রাণ। সীমান্ত বিভাজিত হয়ে যাবার পর নদিয়ায় প্রাণ ভ্রমর রয়ে গিয়েছে কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়া এবং তার আশপাশের জেলা বা ভূখণ্ডই এখন নদিয়া। এটা এখন আর ভূখণ্ড নয়। ‘নদিয়া’ এখন একটি ভাবপরিমণ্ডলের নাম। ছেঁড়িয়াই এখন নদিয়ার হৃদয়। ফকির লালন শাহ আমাদের তাঁর বিখ্যাত ‘তিন পাগলে হোল মেলা নদে এসে’ গানে নদিয়ার যে ‘তিন পাগল’ সম্পর্কে আমাদের জানান দিয়েছেন সেই তিন পাগলের প্রধান ‘পাগল’ শ্রীচৈতন্য বা শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নদিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তার জন্য নদিয়ার অভিমান আছে। তিনি গণমানুষের পক্ষে জাতপাত বর্ণ বিরোধী যে রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু করেছিলেন সেটা আবার উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণের হাতে পড়ে আবার উচ্চকোটির মানুষের বর্গে উঠে যায় বা ফিরে যায়। বৃন্দাবনের গোস্বামিদের অবদানে সংস্কৃত ভাষায় শাস্ত্রচর্চায় টিকাভাষ্যে গৌরাঙ্গের শিক্ষা যে রূপ নিয়ে দাঁড়ায় সেটা আর গণমানুষের ধর্ম বা লড়াই হয়ে টিকে থাকে নি। বিশেষত সুলতানি আমলে ইসলামের জাতপাতবিরোধী লড়াইয়ের সংস্পর্শে যে বৈপ্লবিক রূপান্তরের সূচনা ঘটেছিল সেটাও ক্রমে ম্লান হয়ে যায়। সুলতানি আমল এবং সেই সময় বঙ্গে ইসলামের ভূমিকার বিচার ছাড়া নদিয়ার রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ভাবপরিমণ্ডলের তাৎপর্য বোঝা কঠিন। যদিও সেই দিকে গবেষণা এখনও খুবই অপ্রতুল। কিন্তু তিন পাগলের ‘আসল’ পাগল নিত্যানন্দ থেকে যান নদিয়ায়। অন্য ‘পাগল’ অদ্বৈতাচার্যকে কেন্দ্র করে ‘শান্তিপুর’ ভাবচর্চার আরেকটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু কেউই নদিয়ার গণমানুষের লড়াই ও তত্ত্বচর্চার মূল ধারাটি ধরে রাখতে পারে নি। নদিয়া যতোটুকু এখন অবধি ধরে রাখতে পেরেছে তার ছাপ কিছুটা আমরা পাই বাউল ফকির বয়াতিদের গানে ও সাধুগুরুদের জীবনযাপনে।
যেহেতু ইতিহাস দিয়ে আমরা এই ভাবপরিমণ্ডলকে বোঝার চেষ্টা করি নি ফলে এর রাজনৈতিক মর্ম না বুঝে একে আমরা ‘মরমি’, আধ্যাত্মবাদী’, উদাসি ঘরছাড়া মানুষর বিলাপ কিম্বা নানান গুহ্য সাধনাদি ও তার সঙ্গে গাঁজা সিদ্ধি ও অন্যান্য নেশাদ্রব্য ব্যবহারের পক্ষে বিবিধ যুক্তির বয়ান হিশাবে খাড়া করি। ফকির লালন শাহ ঘোরতর ভাবে সকল প্রকার নেশাদ্রব্যের বিরোধী ছিলেন। নদিয়ার ভাব-পরিমণ্ডলের চূড়ায় আমরা আবির্ভাব দেখি ফকির লালন শাহ।
গৌরাঙ্গ নদিয়া ছেড়ে গিয়েছেন, কিন্তু হাড়িয়া ওঝার সন্তান নিত্যানন্দ যান নি। ঐতিহাসিক তথ্য হিশাবে এই দিকগুলোর ওপর নজর রাখা দরকার। ফকির লালন শা তাই গাইলেন, ‘দয়াল নিতাই কারো ছেড়ে যাবে না’। নিত্যানন্দ- যিনি নদিয়ার জাতপাত বর্ণাশ্রম প্রথা, নারীপুরুষ ভেদ বা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তিনি তাঁর মানুষগুলেঅকে থুয়ে যাবেন না: ‘ধরো চরণ ছেড়ো না, নিতাই কারো ফেলে যাবে না’। নদিয়ায় অতএব নিত্যানন্দ গুরু। গুরুর গুরু তিনি। এখান সন্ধ্যাবাতি জ্বললে লালনের সমাধিস্থানের উল্টো দিকে নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে দৈন্য গান ভেসে আসে, ‘ধরো চরণ ছেড়ো না, দয়াল নিতাই কারো ফেলে যাব না’ কিম্বা নিতাইয়ের কাছে নিবেদন, ‘ফেলো না দূর অধম বলে, চরণ পাই যেন কালাকালে। নদিয়া ও বৃন্দাবনের ভেদবিচার ছাড়া নদিয়াকে বোঝা সহজ নয়। অতএব নদিয়ার এখনকার ভাবের গুরু ফকির লালন শাহকে বোঝাও কঠিন অবশ্যই।
আখড়াবাড়িতে ভক্তের গান শোনার যে আগ্রহ ও ভক্তি তার তুলনা চলেনা, অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে এই আকুতিভরা দৃষ্টি —-
লালনের তিরোধান ও দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দুটো বড় অনুষ্ঠান হয়। প্রধান উদ্যোক্তা লালন একাডেমি। পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানও তাদের নিজ নিজ উদ্যোগে অনুষ্ঠান করে থাকে। মতিজান-লালন ফকির ও অন্যান্য সাধুগুরু সমাধিক্ষেত্রের বিপরীতে রয়েছে নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি। লালন একাডেমির সঙ্গে সমন্বয় রেখে আখড়াবাড়ি তাদের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। লালন একাডেমি ও নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে সারাবছরই ফকির লালন সাঁইজির ‘কালাম’ উচ্চারিত হয়। তাঁর গান ও তত্ত্বচর্চা চলে। সরকারিভাবে পহেলা কার্তিককে মৃত্যু বার্ষিকী হিশাবে উদযাপন করলেও নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি এই দিনটিকে উদযাপন করেছে সাধুগুরুর ভাষায়: ‘তিরোধান দিবস’ হিশাবে। ফকির লালন সাঁইয়ের বিখ্যাত একটি গানের চরণ থেকে এবারের অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল: ‘কি মহিমা করলেন গো সাঁই ! ভারী সুন্দর কথা। গানটির শুরু নিজেদের প্রশ্ন করার মধ্যে যে ‘সাঁইজী কি মহিমা করে গিয়েছেন তাতো বোঝা গেল না। ঠিকই। ফকির লালন সাঁইয়ের মহিমা কতোটুকুই বা আমরা বুঝতে পেরেছি।
এই তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে তিন দিনের অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। হাজার হাজার ভক্তরা দুরদুরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন এই দিনে, সাঁইজীর কাছে এসে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে। এই সময় লালন অনুসারী সাধুরা সাঁইজীর ধামে আসন নিয়ে বসেছেন। কেউ থেকেছেন দুইদিন, কেউ তিনদিন। সাঁইজীর গান গেয়ে ও নিজেদের মধ্যে নানা ব্যাখ্যা তত্ত্বালোচনায় তাঁরা সময় কাটিয়েছেন ভক্তদের নিয়ে।
ফকির লালন শাহ ও কৃষকদের বীজরক্ষার আন্দোলন
ছেঁউড়িয়াতে ফকির লালন সাঁইজী ও অন্যান্য সাধুগুরুদের সমাধিস্থান পেরিয়ে সামনের রাস্তা পেরোলেই নজরে পড়বে নবপ্রাণ আন্দোলনের আখড়াবাড়ী। ১৯৯৪ সাল থেকেই এখানে নবপ্রাণের আখড়া বাড়ীতে সাঁইজীর গানের চর্চা চলছে। শিশুদের লালনের গান শেখানের জন্যে নবপ্রাণ সঙ্গীত ঘর খোলা হয়েছে। তাছাড়া প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠার সাথেই এখানে বসে গোষ্ঠ গানের আসর। আবার সন্ধ্যায় বসে দৈন্য গানের আসর। আখড়াবাড়ীতে এটা নিত্যদিনের অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় নিয়মিত ৫০ থেকে ৬০ জন এসে গান করেন এবং গান শোনেন।
সাঁইজীর তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে নবপ্রাণ আখড়াবাড়ীতে সারাদিন গানের অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে নদিয়ার ভাবের ইতিহাস জানা ও গান ধরে ধরে ব্যাখ্যা শোনার আকুলতা। বহুদূর দূরান্ত মানুষ গানের অর্থ ও ব্যাখ্যা শোনার জন্য আখড়াবাড়িতে রাতদিন থাকেন। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক করেন। একই সঙ্গে লালনের ঘরের বিধান অনুযায়ী কিভাবে ‘সেবা’ বা আহার বিহার চলাফেরা করতে হয় সেই বিষয়েও তাঁরা জানতে আসেন। ‘সাধুসঙ্গে’ সময় কাটান।
সকালে গোষ্ঠগান দিয়ে শুরু হয়, দিনে কয়েকটি ছোট বিরতি দিয়ে সারাদিন গান চলে। তখন হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। এখানে যারা গান শুনতে আসেন, তাঁরা গানের পাশাপাশি এর ব্যাখ্যা শোনার জন্যে আসা ছাড়াও শিল্পীদের একটা বড়
ফকির লবান শাহ (বাঁয়ে) ও করিম শাহ। তিরোধানেরা শেষ মুহূর্ত অবধি ফকির লবান শাহ নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের প্রেরণা হিশাবে কাজ করে গিয়েছেন।
অংশ আসেন গান গাওয়ার সুযোগ পাওয়ার আশায়। আখড়াবাড়িতে গান গাওয়া সবার জন্য উন্মুক্ত। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অখ্যাত অজানা শিল্পীরা যারা সত্যি লালনের গান ভালবেসে চর্চা করেন, তাঁরা বড় মঞ্চে গান গাওয়ার কোন সুযোগ পান না। এখানে যখন উপস্থাপক ঘোষণা দেন আপনারা যারা গান গাইতে চান, নাম এবং গানের কলি লিখে দেবেন তখন খুবই বিনয়ের সাথে তাঁরা এগিয়ে আসেন এবং গান পরিবেশন করেন।
নবপ্রাণের মঞ্চের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে সাধুগুরুরা নিজেরাই গান করেন। যেহেতু এটা আখড়াবাড়ি – এটা পারফরমেন্সের জায়গা নয় সাধুগুরু ও ভক্তদের মিলন স্থান। এখানে যাঁরা গান গেয়ে সুনাম অর্জন করেন তাঁরা একাডেমির মঞ্চে গান গাইবার সুযোগ পান।
এবার নবপ্রাণ আখড়াবাড়ীর অনুষ্ঠানে গানের পাশাপাশি নয়কৃষির কৃষকদের বীজ মেলা বসে। যোগ হয়েছিল নয়াকৃষির কৃষক মেলা। এখানে জড়ো হয়েছিলেন কুষ্টিয়া জেলার ৫টি উপজেলার ৪৮টি গ্রামের প্রায় ৫০০ জন কৃষক। সেটা ছিল ১৬ অক্টোবর, ১লা কার্তিক। সাইঁজীর তিরোধান সংক্রান্ত অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যায় অধিবাসের মাধ্যমে। তাই সকালেই নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা এই মেলার আয়োজন করেন।
সকালেই গ্রাম থেকে ভ্যান গাড়ীতে করে কৃষকরা আসতে শুরু করেন। ঠিক সাড়ে নয়টা বাজতেই তাঁরা একটি র্যালী করে এগিয়ে যান সাঁইজীর ধামে। তাঁরা নীববে এগিয়ে যান এবং সাঁইজীর সমাধিস্থলে গিয়ে সবাই চারিদিকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। কয়া গ্রামের প্রবীণ কৃষক আব্দুল খালেক একটি হাতে বানানো বড় মোমবাতি সবার পক্ষ থেকে জ্বালিয়ে দিয়ে আসেন। তাঁদের হাতে যে ব্যানার ছিল তাতে লেখা ছিল কৃষক মেলা ১৪১৬ ‘প্রকৃতি ও প্রাণের সুরক্ষা ও বিকাশে এগিয়ে আসুন’।
‘প্রকৃতি ও প্রাণের সুরক্ষা ও বিকাশে এগিয়ে আসুন’
নয়াকৃষির কৃষক মেলা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কুষ্টিয়াতে ফকির লালন সাঁইজীর মতো এতো বিশাল মাপের মানুষ রয়েছেন অথচ এখানে গ্রামে গ্রামে তামাক কোম্পানীর উদ্যোগে তামাক চাষ করা হচ্ছে হাজার হাজার একর জমিতে। সব্জি চাষ করতে গিয়ে কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই কুষ্টিয়াতে ফকির লালন সাঁইজীর গানের চর্চা করতে এসে নয়াকৃষি আন্দোলনের কাজ শুরু করতে হয়েছে ১৯৯৪ সাল থেকে। তখন থেকেই কৃষকদের নেতৃত্বে নয়াকৃষি আন্দোলনের সাথে হাজার হাজার কৃষক যুক্ত হচ্ছে এবং তাঁরা একটি আনন্দময় জীবন গড়ে তুলছেন ও আনন্দময় জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলবার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
নয়াকৃষি মনে করে এই বিশ্বজগত, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা প্রকৃতি আনন্দময়। ভাবে, সংকল্পে, পরিকল্পনায় ও কাজে এই আনন্দকে নিরিখে রেখে সৃষ্টি, সৃষ্টির শর্ত ও সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও বিকাশই সত্যিকারের ধর্ম। আনন্দের নিরিখে কৃষি কাজে সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য সহজ দশটি নীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করে নয়াকৃষি। সেই প্রয়োগ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন, নতুন শিক্ষালাভ, গবেষণা, পরীক্ষানিরীক্ষা ও আবিষ্কারের দৈনন্দিন চর্চায় নয়াকৃষি বিকশিত হয়ে চলেছে সারা বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে।
নয়াকৃষি আন্দোলন মানুষসহ গাছ-পালা, লতা-গুল্ম, পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ – প্রতিটি প্রাণী প্রতিটি জীব-অনুজীবের প্রতি ভালবাসা ও মায়া মমতার ওপর দাঁড়ায়। জীবন ও জগতের প্রতি আনন্দময় দৃষ্টিভঙ্গি বহাল রেখে মানুষের সঙ্গে মানুষের সকল প্রকার অসাম্য, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন ভবিষ্যৎ গড়তে চায় নয়াকৃষি। এখানেই নয়াকৃষির সঙ্গে বাংলার ভাবুক ও সাধকদের সঙ্গে নয়াকৃষির মৈত্রীর জায়গাটি গড়ে উঠেছে। নয়াকৃষি আন্দোলনের নেতা, ভাবুক আর উদ্যোগী স্বয়ং কৃষকরাই। নয়াকৃষি আন্দোলনের খুবই কেন্দ্রীয় পুরুষ অতএব ফকির লালন শাহ। তাঁর বাণী ছাড়া এই আন্দোলন সংঘটিত করা অসম্ভব।
মেলা উদ্বোধন করেন লালন একাডেমির সাধারণ সম্পাদক জনাব তাইজাল আলী খান। অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন সাধুগুরুদের মধ্যে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন মহাত্মা কোকিল শাহের শিষ্য ফকির আব্দুর রব। শুরুতে নবপ্রাণের শিল্পীরা গেয়ে ওঠেন ‘অমৃত মেঘের বারী, শুধু কথায় কি মেলে ……’ তারপর কৃষকরা গাছ-পালা, পশু-পাখী, লতা-গুল্ম, নদী, পানিসহ প্রকৃতির সব কিছু রক্ষার জন্যে একটি করে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। এরপর নয়াকৃষির কৃষকরা প্রধান অতিথি জনাব তাইজাল আলী খানকে একটি হরিতকি গাছ এবং ফকির আব্দুর রবকে একটি নিম গাছের চারা উপহার দেন। কৃষকদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় সাঁইজীর ধামে হাইব্রিড ফুলের গাছ নয়, ওষুধি গাছ এবং ফলফলাদির গাছ লাগানো হোক, এমন গাছ লাগানো হোক যে গাছ বাংলাদেশের। এক ধরণের জাত বা প্রজাতিও নয়, লাগানো হোক বিভিন্ন জাত ও প্রজাতির গাছ। বিশেষত সেইসব গাছগুল্ম লতাপাতা যেখানে পাখী এসে বাসা বানাতে পারে, প্রাণীদের আবাসস্থাল হয়, জীবের আশ্রয় হয়ে ওঠে। তার নীচে সাধুগুরুরা এসে যেন বসতে পারেন। যেমন একসময় বসেছিলেন ফকির লালন শাহ ও তাঁর শিষ্যরা। প্রধান অতিথি এবং সভাপতি মিলে প্রায় ১৪ জন কৃষককে কৃষিতে বিশেষ অবদানের জন্যে সম্মাননা প্রদান করেন। তাইজাল খান অন্যান্য কথার সাথে যে কথাটি গুরুত্ব দিয়ে বলেন তা হচ্ছে, ফলজ গাছ লাগানোর নিয়ত করতে হবে, কেন না কোন না কোন প্রাণী ফল খাবে। বিশেষ করে পাখী। তাদের খেতে না দিলে বাঁচবে কি করে। বৃক্ষ লাগিয়ে পাখী বাঁচাতে হবে। পাখীর গান শহর থেকে চলে গেছে এখন গ্রাম থেকেও চলে যাচ্ছে।
সভাপতির ভাষণে ফকির আব্দুর রব বলেন, আমরা নানান ভাব সাঁইজীর নাম নিয়ে থাকি। আমরা বলি, সমস্ত সৃষ্টির মালিক আল্লাহ। বলি যে আমি অতীতে কি করেছি, ভবিষ্যতে কি করবো সেটা সেই মাবুদ জানে। এই যে ‘আতশু সমর্পণ’ বা আমাদের সাধুগুরুদের ভাষায় ‘ভক্তি’ কিন্তু কই সেই মহানের গুনগান তো আমরা করি না। আমি ৭২ বছর যাবৎ সাধুদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অথচ আমারই আজ পর্যন্ত কিছু হলো না। নয়াকৃষিতে ১০ নীতি আছে। নয়াকৃষিতে নীতি না থাকলে এটা নয়াকৃষি হোত না। আমাদের চলার পথে পবিত্র নীতি হচ্ছে চরিত্র। এই বলে তিনি গেয়ে ওঠেন ‘পড়েছি অকুল পাথারে, দাও এসে চরণ তরী আমায়। এসো হে অপারের কান্ডারী।’
কৃষকরা সেদিন ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁরা নিজেদের কাজের কথা তুলে ধরছিলেন একের পর এক। বিশেষ করে কীটনাশক, বা সহজ কথায় বিষ ব্যবহার বন্ধ করার জন্যে ছিল তাদের আহ্বান। আধুনিক কৃষির ক্ষতিকর অভিজ্ঞতা ভোলা যায় না। একজন কৃষক বললেন, রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহার করে আমরা অধঃপতনে যাচ্ছি। লাভের আশায়, বেশী টাকা পাওয়ার আশায় আমরা সব কিছু ধ্বংস করে দিচ্ছি। নয়াকৃষিতে আসার পেছনে আমাদের মূল শক্তি হচ্ছে সার কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করেও নিরাপদ ও অধিক ফসল ফলানো। নয়াকৃষি প্রমাণ করেছে সেটা সম্ভব।
সবচেয়ে কষ্টকর ছিল পাখীর কথা শোনা। মির্জাপুর গ্রামের কৃষক আজের আলী পাখীর কথা বলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন। তাই একটি কাগজে দুইশত সত্ত্বরটি (২৭০টি) পাখির নাম লিখে আনেন এবং পড়ে শোনান। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে কীটনাশকের ব্যবহার এবং গাছ কেটে ফেলার কারণে এই পাখী এখন নাই। পাখীর খাদ্য নাই। জমিতে বিষ ব্যবহারের কারণে পোকা মাকড় সব মরে গেছে। গাছ নাই, তাই পাখীর খাদ্য পাওয়া যায় না।
শমশের মালিথা প্রায় ৯১ বছর বয়স। দুঃখ করে বললেন, আগে অনেক ধান নিজে আবাদ করেছি। আউশ ধান ছিল, আমন ধান ছিল অনেক জাতের। ভাদ্র মাসে যে ধান হোত সেই ধান খুব মিষ্টি। এখন বিঘা প্রতি ১৬/১৮ মন ধান হচ্ছে। এখন তামাক চাষ হচ্ছে। পেটে ভাত নাই, অথচ কেউ কেউ মোটর সাইকেলে চড়ে বেড়াচ্ছি। আগে রোগ ছিল না, এখন নানা রকম রোগ হয়েছে। আম গাছে আম নাই, ৬০ টাকা কেজি আম কিনে খাই। আগে আমার গাভী ছিল ২২টি, এখন নাই। এখন ষাঁড় পুষি ঢাকায় বেশী টাকায় বিক্রির জন্য।
গোপালপুরের কৃষক গোলাম মোস্তফা খোলামেলা কথা বলেন। তিনি হাইব্রিড বীজে ব্যাপারে কৃষকদের সাবধান করে দিয়ে বলেন, হাইব্রিড বীজের চাষ বিষ ব্যবহার ছাড়া সম্ভব না। অথচ হাইব্রিড ধান কোন কৃষক ১০ মনের বেশী আবাদ করতে পারে নাই। এখন কৃষকের গরু নাই। চাষ চলে গেছে পকেটে। দোকানে বসে চাষের হুকুম করি, জমি চাষ করে দিতে। দোকানীরা বলে দেন হাইব্রিড ধানের বীজ রাখা যাবে না। নয়াকৃষির কৃষকরা দেশীয় বীজ দিয়ে চাষ করেন, তাঁদের এতোসব কিছু করতে হয় না।
তামাক চাষ মারাত্মক ক্ষতি করেছে। আমিনুল গাইন বলেন, আগে তামাক চাষী ছিলাম। ক্ষতিটা অনুভব করে তামাক বন্ধ করেছি। তামাকের কারণে বনজ, ফলজ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ কেটে কেউ ঘরবাড়ী তৈরি করি নাই। গাছ কেটে তামাক পোড়াইছি। তামাক মাটি নষ্ট করেছে। দীর্ঘদিন একই জমিতে তামাক করলে এক ধরণের পরগাছা (যাকে কৃষকরা নাম দিয়েছে মুলা) বের হয়। এই জমিতে আমর কোন ফসল হয় না। তামাকের জমিতে এক বছর ২০ কেজি সার দিলে পরের বছর ৩০ কেজি সার না দিলে তামাক হবে না। তামাক কোম্পানী এসে আমাদের লোভ দেখাচ্ছে।
হাসান শাহ ও নজরুল শাহ
আবেগ নিয়ে মাছের কথা বলেন শাহেরা খাতুন। মাছের দেশ ছিল আমার বাড়ী। বিলের নীচু জায়গায় ছিল মাছ। কিন্তু বিষের কারণে মাছ ধরে রাখতে পারি নাই। ছোট ছোট অনেক মাছ এখন আর দেখাই যায় না। এরই সাথে যোগ হয় কৃষক মোসলেম উদ্দিনের কথা। তিনি ৪৩টি মাছের নাম উচ্চারণ করে বলেন এই মাছ এখন খুবই কম পাওয়া কিংবা নেই।
শুধু কৃষক নয়, বাঁশ-বেতের শিল্পী অনুকুল কুমার বলেন প্লাস্টিক ও মেলামাইন হওয়াতে তাদের হাতের বানানো জিনিসের বিক্রি হয় না। কুমার গৌতম পাল বলেন মাটির হাড়ি-পাতিল পোড়াতাম আমরা আগে যে ধান হোত সেই ধানের খড় দিয়ে। ইরি ধানের খড় ছোট। সেটা আমাদের কাজে লাগে না। কৃষকরা বীজ রাখতো মাটির হড়িতে, এখন বীজ হারিয়ে যাচ্ছে, ঘরে বীজ রাখছে না। সিলভারের বাসন ব্যবহার করছে, কাজেই মাটির বাসনের বিক্রি হচ্ছে না। আমরা আগে বৈশাখ মাসে মাটি সংগ্রহ করতাম এখন সেখানে সেচের পানি থাকে। আমরা মাটি পাই না। তবে নয়াকৃষির এই উদ্যোগ আমাদের শিল্পকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। এভাবে কেউ হারানোর বেদনার কথা, কেউ আবার ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়ে বিকাল পর্যন্ত চলে আলোচনা। সবশেষে প্রদীপ হাতে নিয়ে শপথ নেন কৃষকরা। ফরিদা আখতারের পরিচালনায় সকল কৃষক শপথ গ্রহণ করেন, কোন প্রকার বিষ ব্যবহার না করা, প্রকৃতিকে রক্ষা করা, কৃষক, জেলে, কামার, কুমার সকলের জীবন জীবিকা রক্ষা করার। কৃষকরা পরিষ্কারভাবে হাইব্রিড বীজ এবং জিএমও প্রতিহত করার অঙ্গীকার করেন। এবং যারা প্রকৃতির এই ক্ষতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে কৃষক আদালত গঠন করার ঘোষণা দেন। সন্ধ্যায় দৈন্য গানের আসর শুরু হয়, ‘কি মহিমা করলেন গো সাঁই’।
সাঁইজীর ধাম ক্রমশ তথাকথিত কৃত্রিম আধ্যাত্মিকতার, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ‘মরমি’ মধ্যবিত্তসুলভ আহাজারির পরিবর্তে কৃষক ও মাটির মানুষের পদচারনায় মহৎ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। সত্যি সত্যিই সাধুগুরুর সাধবাজার হয়ে উঠছে। এই নদিয়াই আগে এমন ছিল যা ছিল শস্যের ভাণ্ডার। মানুষ বিশ্বাস করত সাধুগুরুরা যে পথে হেঁটে যেতেন সেই পথ শস্য শ্যামল হয়ে উঠত। প্রাণের উৎসব লেগে থাকত সবসময়। যেখানে ইহলৌকিকতার সঙ্গে পরমার্থিকতার কোন ভেদ নাই সেই দেশ উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথেই তো এগুবে। নয় কি? শুধু ডুগডুগি বাজিয়ে গান করা বাউলেপনার গুরু নন ফকির লালন শাহ। ইহলোকেই আনন্দের আগমনী গেয়েছিলেন যিনি, রক্তমাংসের বাস্তব মানুষের ভজনার দীক্ষা দিয়েছিলেন যিনি, তাঁর জয় হোক।